প্রথম পর্বঃ
বিশেষ প্রতিবেদকঃ ইয়াবা একধরনের নেশা জাতীয় ট্যাবলেট । এটি ‘মেথাফেটামাইন’ ও ‘ক্যাফেইন’ এর মিশ্রণ। ইয়াবার মূল শব্দের উত্পত্তি থাই ভাষা থেকে। এর সংক্ষিপ্ত অর্থ ‘পাগলা ওষুধ’। অনেকে একে বলে থাকেন ‘ক্রেজি মেডিসিন’। জেনে রাখা আবশ্যক, এই ট্যাবলেট টি মুলত হিটলার এর সময়ে নাৎসি সেনাদের বড়ি হিসেবে সেবন করান হত যেন যুদ্ধ চলাকালিন তারা ২৪ ঘন্টার অধিক সময়ে জেগে থাকতে পারে। কিন্তু ইদানিং ট্যাবলেট টি মাদক দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ( ১৯৩৯-১৯৪৫) ইয়াবা আবিষ্কার করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সেনাদের ক্লান্তি দূর করে তাঁদের মধ্যে উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনতে জার্মান প্রেসিডেন্ট অ্যাডলফ হিটলারের আদেশে ইয়াবা আবিষ্কৃত হয়। টানা পাঁচ মাসের চেষ্টায় দেশটির বিজ্ঞানীরা এটি তৈরি করেন।
ইয়াবার মূল উপাদান মেথঅ্যামফিটামিন। চিকিত্সকেরা জানিয়েছেন, ইয়াবা সেবনে মস্তিষ্ক, হূদযন্ত্রসহ শরীরের যেকোনো অঙ্গই আক্রান্ত হতে পারে। ধীরে ধীরে এটি অকেজো করে দেয় পুরো শরীর, মন ও মানসিকতার। ইয়াবা আসক্তির কারণে মস্তিষ্কের বিকৃতিও হতে পারে। কখনো কখনো ইয়াবার সঙ্গে ক্যাফেইন বা হেরোইন মেশানো হয়, যা ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। ইয়াবা একসময় সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ক্ষুধা কমিয়ে দেওয়ার কারণে ইয়াবা ওজন কমানোর ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত হয়। তবে ক্লান্তি কাটাতে অনেক শিক্ষার্থী, দীর্ঘ যাত্রার সময় গাড়িচালক এবং দৌড়বিদ ইয়াবা আসক্ত হয়ে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব জানা গেলে বিশ্বব্যাপী ইয়াবার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে ইয়াবা উত্পাদনে শীর্ষে রয়েছে মিয়ানমার। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমান থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে পাচার শুরু হয়।
ওসি প্রদীপ ও আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ডের পর কিছুদিন ইয়াবা পাচার কমে আসলেও সম্প্রতি তা আবার ব্যাপকহারে বেড়েছে। আর এজন্য পাচারকারীরা নিত্যনতুন রুট পরিবর্তন করেছে। সীমান্তের বিভিন্ন পাহাড়ি সড়ক ব্যবহার করে খুব নিরাপদে পাচার করছে কোটি টাকা মূল্যের ইয়াবা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা পদক্ষেপের পরও থামছে না ইয়াবা প্রবেশ। এর উৎসভূমি মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে ভয়াবহ এ মাদক। এছাড়া বঙ্গোপসাগর হয়ে উপকূলীয় বিভিন্ন সীমান্ত দিয়েও আসছে ইয়াবার চালান। এসব অঞ্চলে ৪বছরের বেশি সময় ধরে চলছে মাদকবিরোধী অভিযান। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তালিকাভুক্ত এবং এর বাইরে থাকা মাদক কারবারিরা আটক হয়েছে। কিন্তু অধরা থেকে যাচ্ছে অধিকাংশ ইয়াবার নেপথ্য নায়করা। নানা কৌশলে তারা মাদকের এ অবৈধ ব্যবসা জিইয়ে রেখেছে। সমাজের সচেতন মহল ও সংশ্লিষ্টদের অভিমত, শুধু অভিযানেই বন্ধ হবে না মাদক প্রবেশ। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অভিযানের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সীমান্তে নিশ্ছিদ্র প্রহরা, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত বন্ধ, মাদকের চাহিদা হ্রাস, মাদকসেবীদের পুনর্বাসনসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া একক কোনো বাহিনীকে দায়িত্ব না দিয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান পরিচালনা করলে মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তারা।
উখিয়া টেকনাফ মায়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায়, মায়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে ইয়াবা চোরাচালানের একটি নিরাপদ রুট বিবেচনায় রেখেই তাদের ইয়াবা কারখানাগুলো বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিষ্টা করেন। মায়ানমার সরকার কতৃপক্ষ ঠান্ডা মাথায়, জেনে-বুঝে, তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করে ও ইয়াবা প্রতিরোধে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনায় রেখে তাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রায় ৩০/৩৫ টি ইয়াবা কারখানা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় চালু রাখেন। সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি, কোষ্টগার্ড, মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর ও অন্যান্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে যুবসমাজ ধ্বংসকারী মরণ নেশা ইয়াবা।
সীমান্ত ঘেষা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক, মেরিনড্রাইভ সড়ক ও সাগর পথ দিয়ে প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকার ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে। এ ইয়াবা পাচার বন্ধ করতে জেলার আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের তৈরি ইয়াবার বিস্তার বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শহরের অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বানিজ্যিক এলাকা সহ পাড়া মহল্লায় হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা। উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই এদেশে প্রবেশ করছে লাখ লাখ পিচ ইয়াবার চালান। প্রায় সময় ইয়াবা আটকের ঘটনা ঘটলেও ইয়াবার চালান আসা বন্ধ হয়নি। বরং প্রায় প্রতিদিনই এর সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। উখিয়া-টেকনাফ উপজেলার আনাচে-কানাচে ইয়াবা পাচারে নারী পুরুষ, রোহিঙ্গা যুবক,যুবতী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মীরাও জড়িয়ে পড়েছে মাদক নেশা ইয়াবার চক্রে। জানা গেছে, উখিয়া টেকনাফ উপজেলার অন্ততপক্ষে ৩০-৩৫ টি ইয়াবা সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে মরণঘাতী এ বানিজ্য নিয়ন্ত্রনে। প্রায় প্রতিদিনই আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে দেশের বিভিন্নস্থানে ইয়াবা আটকের ঘটনা ঘটছে। এসব আটকের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠিকই নিদ্দিষ্ট গন্তব্যে ইয়াবা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযানে ইয়াবা আটকের সময় মাঝে মধ্যে পাচারকারী আটক হলেও এর সাথে জড়িত রাঘববোয়াল বা গড়ফাদাররা আটক না হওয়ায় ইয়াবা পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অব্যাহত অভিযানেও সীমান্তে ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়নি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অন্তত ৩০টি কারখানায় এখনও পুরোদমে চলছে ইয়াবা উৎপাদন। তবে কারবারে ভাটা পড়ায় ওপারের কারখানা মালিকরা এপারের কারবারিদের কাছে বাকিতেই ইয়াবা সরবরাহ করছে। সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আগের সেই রমরমা অবস্থা না থাকলেও সীমান্তে ইয়াবা পাচার এখনও বন্ধ হয়নি। ছোট ছোট চালানে ইয়াবা বাংলাদেশে ঢোকাচ্ছে রাখাইনের কারবারিরা। এ জন্য নতুন নতুন রুটও তৈরি করছে তারা। টেকনাফে বিজিবির একজন কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন বিষয়টি। তিনি জানান, রাখাইনের সীমান্ত এলাকায় অন্তত ৩০টি কারখানায় এখনও ইয়াবা উৎপাদন হচ্ছে। গভীর চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ওপারের ইয়াবা কারখানা মালিকরা এখন বাকিতে এপারের কারবারিদের কাছে ইয়াবা সরবরাহ করছে। কোনো চালান ধরা পড়লে পুরো টাকা মাপ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইয়াবা বিক্রীর টাকা জমা দেবার বিশ্বস্ত ব্যক্তি রয়েছে। ঐসব মধ্যস্বত্তভোগীরা দেশীয় বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে ইয়াবার টাকা পয়সা বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে ঠিকই উৎস স্থল মায়ানমারে পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছেন। মায়ানমার কর্তৃপক্ষ ও ইয়াবা কারবারিরা ইয়াবা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এখন যেকোন ভাবে মরিয়া।
ইয়াবা দেশজুড়ে যেন মহামামারি আকার ধারণ করেছে। একের পর এক মাদক বিরোধী অভিযানের পরেও কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছেনা ইয়াবার চালান। আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মাঝে ও পাচার হচ্ছে ইয়াবা। এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার করার পর টেকনাফ থেকে পালিয়ে আসা শতাধিক তালিকাভূক্ত মাদককারবারী কক্সবাজারে আলীশান জীবন যাবন করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মাদককারবারীরা কেউ নেতা পরিচয়ে, কেউ মানবাধিকারের সনদধারী পরিচয় নিয়ে, কেউ বৈধ/অবৈধ ব্যবসার নামে ছদ্মবেশে কক্সবাজারে বসবাস করছে। শহরের বাসটার্মিনাল এলাকা,হাজী পাড়া, কালুরদোকান, তারাবনিয়াছড়া,আলিরজাহাল, নুনিয়াছড়া, ৬ নং ফিশারীঘাট, কলাতলী সহ প্রায় ২০টি পয়েন্টে উখিয়া-টেকনাফের বড় বড় কারবারী ভিআইপি বাসা নিয়ে, অনেকে ফ্লাট ক্রয় করে সপরিবারে বসবাস করছে। তম্মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচয় গোপন করে ফিশিংট্রলার ক্রয় করেছে কক্সবাজারের মাদককারবারীদের সাথে যৌথ পার্টনার হিসাবে। কক্সবাজারের ফিশারীঘাট সহ বেশ কয়েকটি জায়গায় তারা ইয়াবার ডিপো বানিয়েছে। তাদের সাথে নুনিয়ারছড়া ও চৌফলদন্ডী ঘাটে খালাস করা ইয়াবার যোগসাজ রয়েছে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল একাধিক মহল। কক্সবাজারের ট্রাঞ্জিট পয়েন্ট হিসেবে উক্ত এলাকাকে চিহ্নিত করা গেলেও, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলাশহর, সীমান্তবর্তী উপশহরকে তারা ইয়াবা চোরাচালানের রুট ম্যাপ হিসেবে ব্যবহার করছেন অতি সংগোপনে।( চলবে……… )
আইকন নিউজ/আ র/ ০৩/৯৩/২০২১