এম আর আয়াজ রবিঃ
(গত বছরের ঠিক এই দিনে আমার লেখা নিউজটি পাঠকের জ্ঞাতার্থে আবার উপস্থাপন করা হলঃ)
করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিশ্বজুড়েই ফুসফুসের স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখার জন্য অতি প্রয়োজনীয় সাপোর্ট সরঞ্জামের নাম ভেন্টিলেটর। করোনায় মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রনে রাখতে চিকিৎসকরা বরাবরই জোর দিচ্ছেন ভেন্টিলেটর আমদানি ও উৎপাদনে। অধুনা করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী রুপ ধারন করায় এবং লক্ষ লক্ষ লোক আক্রান্ত ও মৃত্যু বরণ করায় বিশ্বব্যাপী ভেন্টিলেটরের সংকট চলছে।
## ভেন্টিলেটর কিভাবে কাজ করে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর মতে, হাসপাতালের চিকিৎসা ছাড়াই করোনাভাইরাসে রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশ সেরে উঠছেন। কিন্তু আক্রান্তদের প্রতি ছয়জনের মধ্যে গড়ে একজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এসব ক্ষেত্রে ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফুসফুসের। এছাড়া শরীরের রোগপ্রতিরোধী ব্যবস্থা সেটা বুঝতে পারে ও ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে জন্য বেশি সংখ্যায় রক্তকোষ সেখানে পাঠাতে থাকে। রক্তবাহিকাগুলো ফুলে ওঠে।
এতে অন্য একটি সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফুসফুসে তরল ঢুকে যাওয়া। এমন ক্ষেত্রে শ্বাস নেয়া আরও কঠিন হয়ে ওঠে। শরীরের অক্সিজেনের যোগান তাতে কমে যায়। আর অক্সিজেনের যোগান বাড়াতেই দরকার পড়ে ভেন্টিলেটরের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও জানায়, এটি অক্সিজেনযুক্ত হাওয়া পাম্প করে ঢোকায় নাক দিয়ে। ভেন্টিলেটরের হাওয়ার তাপমান ও আর্দ্রতা যাতে রোগীর দেহের সঙ্গে মেলে, তার জন্য ভেন্টিলেটরে থাকে হিউমিডিফায়ার নামে একটি অংশ। শ্বাস নেয়া ও ছাড়ার সঙ্গে যুক্ত পেশিগুলোর উপরে চাপ কমাতে বা সেগুলো শিথিল রাখতে প্রয়োজন মতো ওষুধও দেয়া হয়। এতে রোগী ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে তাকে হারিয়ে দেয়ার জন্য বাড়তি সময় পেয়ে যান। শ্বাসকষ্ট অল্প হলে সাধারণ (নন-ইনভেসিভ) ভেন্টিলেশনেই কাজ হয়। এ ক্ষেত্রে নাকে-মুখে একটি মাস্ক লাগিয়ে অক্সিজেনযুক্ত হাওয়া বাড়তি চাপে পাঠানো হয়। কিন্তু (মেকানিকেল) ভেন্টিলেটরে দিলে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে এই যন্ত্রটির হাতে। আর এ জন্যই চিকিৎসক ও সেবাকর্মীদের নিরন্তর ও তীক্ষ্ণ নজরদারি একান্ত জরুরি।
## Dr. Heather Davis এর মতে কোভিড-১৯ এর ভেন্টিলেশান
একটি নল, যা আপনার গলা দিয়ে নামানো হয় আর মরা বা বাঁচা পর্যন্ত রাখা হয়। রোগীরা কথা বলা, খাওয়া বা স্বাভাবিক কিছুই করতে পারে না- যন্ত্র তাঁদের বাঁচিয়ে রাখে।এতে যে ব্যথা বা অস্বস্তি হয়, তার থেকে বাঁচার জন্য মেডিকেল এক্সপার্টরা ব্যথানাশক ও চেতনানাশক দিয়ে রাখেন যেন আপনি নলটা সহ্য করতে পারেন। এভাবে চিকিৎসার ২০ দিন পর একজন কমবয়েসের রোগী তার ওজনের ৪০ ভাগ হারায়, মুখে আর স্বরনালিতে ঘা হয়ে যায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ফুসফুস বা হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। এই কারণেই বৃদ্ধ বা দুর্বল স্বাস্থ্যের রোগীরা এই চিকিৎসা নিতে পারে না, মৃত্যুবরণ করে।
তরল খাবারের জন্য আপনার পাকস্থলীতে নল দেওয়া লাগে, তা নাক দিয়ে বা চামড়া ছিদ্র করে হোক, তরল মল ধরার জন্য একটা ব্যাগ লাগানো হয়, প্রস্রাব ধরার জন্য নল আর স্যালাইনের জন্য শিরাপথে নল দিতে হয়। দুই ঘন্টা পরপর একজন নার্স বা স্বাস্থ্য সহকারী আপনার হাত পা নাড়াচাড়া করিয়ে দেয় আর আপনি পড়ে থাকেন একটা তোশকের ওপরে, যার ভিতর দিয়ে বরফ ঠান্ডা তরল আপনার বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। এসময়ে আপনার আপনজনেরা আপনার কাছে আসতে পারেন না। একটি ঘরে একা আপনি আর আপনার যন্ত্র।
আর কেউ কেউ বলে,মাস্ক পরে থাকা অস্বস্তির।
## প্রসঙ্গ দেশীয় ভেন্টিলেটর তৈরি
বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেল করপোরেশন এবং হেলথ ডিভাইস প্রস্তুতকারক ‘মেডিট্রনিক’-এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত জনাব ওমর ইশরাক। তিনি গত এপ্রিলের শুরুর দিকে এক টুইট বার্তায় জানান,” বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে ‘মেডিট্রনিক’ ভেন্টিলেটর তৈরির কলাকৌশল উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, যেন এ দুর্যোগের সময় সক্ষম যেকোনো প্রতিষ্ঠান ভেন্টিলেটর উৎপাদন করতে পারে। পিবি ৫৬০ নামের ওই ভেন্টিলেটরের পেটেন্ট উন্মুক্ত করা হয়েছে”। তাই এই ‘লাইফ সেভিং ডিভাইস’-এর পেটেন্ট, সফটওয়্যার, সোর্সকোডসহ যাবতীয় সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন উক্ত ‘মেডিট্রনিক’-এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মিঃ ওমর ইশরাক। ইতিমধ্যে পেটেন্ট উন্মুক্ত করায় স্থানীয় প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশে ভেন্টিলেটর উৎপাদনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন মাননীয় ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ প্রতিমন্ত্রী জনাব জুনাইদ আহেমদ পলক। প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর আহবানে কয়েকটি ইলেকট্রিক্স পন্য প্রতিষ্টান এগিয়ে আসলেও খুব জোরালোভাবে সাড়া প্রদান করেছিলেন,বাংলাদেশের অন্যতম ইলেকট্রনিক্স পন্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান মিনিস্টার গ্রুপ। মাননীয় মন্ত্রী বলেন, ‘পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায় তখন আমাদের ভেন্টিলেটর খুবই প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশেরই কৃতী সন্তান ওমর ইশরাক সাহেব তাঁর পেটেন্ট যেহেতু উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, আমরা ‘মেডিট্রনিক’ এর সহায়তায় দেশে ডিজিটাল ডিভাইস নির্মাতা কম্পানিগুলোর সহায়তায় শিগগিরই এটি তৈরি করতে পারব।’
এ প্রসঙ্গে মিনিস্টার হাইটেক পার্ক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান জনাব এম এ রাজ্জাক খান বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ভেন্টিলেটর তৈরি করার জন্য প্রস্তুত এবং ভেন্টিলেটরটির নামকরণ করাও হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেফ লাইফ মিনিস্টার ২০২০’। মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের হেড অব ব্র্যান্ড ও মিডিয়া কে এম জি কিবরিয়া বলেন, ‘আমরা পরীক্ষামূলকভাবে একটি তৈরি করেছি। এটি কনফার্ম হওয়ার পর চূড়ান্ত উৎপাদনে যেতে পারব। বর্তমান করোনাভাইরাসের সংকটে সরকারকে সহায়তা করতে আমাদের কর্তৃপক্ষ এ উদ্যোগ নিয়েছে।’ মিনিস্টার কর্তৃপক্ষ খুব স্বল্প মূল্যে কোনপ্রকার মার্জিন না রেখে করোনা আক্রান্তদের জীবন বাঁচাবার জন্য ৭০ থেকে ৮৫ হাজার টাকার মধ্যে এটি বাজারে সরবরাহ করার ঘোষনাও আসে। প্রাথমিকভাবে উৎপাদিত ভেন্টিলেটরের ১০ শতাংশ ক্রয় করে বিভিন্ন হাসপাতালে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এফবিসিসিআই। এই উদ্যোগের প্রশংসা করছন আইসিটি মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রনালয়।
উক্ত কর্মসূচিতে ‘মিনিস্টার ইলেক্ট্রনিক্স’কে সহায়তার হাত প্রশস্ত করার কথা-ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই), কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী।
গত ১৯-এপ্রিল-২০২০ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেশেই ভেন্টিলেটর তৈরি হচ্ছে খবরটি খুব ফলাওভাবে প্রকাশিত হল। দেশের মানুষ অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও একটা সুখবর পেয়ে যার পর নাই আনন্দিত হল। আমরাও আশার বুক বেধে অপেক্ষায় ছিলাম দেশীয়ভাবে ভেন্টিলেটর উৎপাদিত হবে, গরীব দেশের মানুষ স্বল্প মূল্যে ভেন্টিলেটর পাবে এবং অন্তত করোনার ভয়ংকর ছোবল থেকে রক্ষা পাবে দেশ ও দেশের মানুষ।যেসময়ে উক্ত ঘোষনা প্রকাশিত হলো তখন ছিল এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়, করোনার ভয়াবহতা আজকের অবস্থায় তখনও পৌছায়নি। আমরা আশায় ছিলাম সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে অন্তত ভেন্টিলেটরের কোন অভাব হবেনা যেহেতু নিজের দেশেই উন্নত মানের ভেন্টিলেটর তৈরি হচ্ছে। তখন উদ্দ্যোক্তারা দাবি করেছিল, দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে, এমন কী ইউরোপ, আমেরিকার মত দেশগুলোতেও ভেন্টিলেটর রপ্তানী করার চিন্তাও মাথায় ছিল!
আমরা বাংগালী। অল্পতে তুষ্ট এবং অল্পতে ত্রাহি ত্রাহি ভাব !! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মেডিট্রনিক’ এর পেটেন্ট উন্মুক্ত করায় ঘোষনায় আমরা রাতারাতি ভেন্টিলেটর তৈরি করে দেশের চাহিদা পূরন করে বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। একবার ও চিন্তা করলাম না, বৈশ্বিক অবস্থার কথা!বিশ্বের কত বাঘা বাঘা দেশ করোনায় ভেন্টিলেটরের অভাবে নাকানি চুবানি খেয়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়েছে। আর আমরা নাকি ভেন্টিলেটর তৈরি করে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানী করব! যদি তাই-ই হতো, দেশের সব নাগরিকের সাথে আমিও বেশ পুলকিত হতাম, বৈকি! কিন্ত কী হলো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমার সেই স্কুল বা কলেজ জীবনের মূখস্থ করা ভাবসম্প্রসারনটির কথা মনে পড়ে গেল “হাতি ঘোড়া গেল তল, পিঁপড়া বলে কত জল”! হায়রে বাংলাদেশের কত আবেগী মানুষ আমরা!
হায় বিধিবাম! ভেন্টিলেটর তৈরি তো দূরে থাক, যারা ভেন্টিলেটর নিয়ে কথা বলেছিলেন, ভেন্টিলেটর নিয়ে দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন-তাঁরা এ ব্যাপারে কোথায় কী করেছেন না করছেন, ভেন্টিলেটর দেশে উৎপাদন আদৌ হবে কিনা বা আসলেই ভেন্টিলেটর দেশে উৎপাদন করার মত সক্ষমতা আছে কিনা বা উৎপাদন যদি শুরুই করে থাকেন দেশের মানুষ সেবা পেতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে বা আদৌ ভেন্টিলেটর পাবে কিনা তা দেশের মানুষ যেমন জানেনা ঠিক আমরাও জানিনা এখনও। কিন্তু করোনার ভয়াবহতা সারা দেশকে কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশে সরকারি হিসেবে এখন প্রায় চল্লিশ হাজারের উপরে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, ইতিমধ্যে সরকারি হিসেবে মারা গেছেন প্রায় সাড়ে পাচশত মানুষ, (অনেকেই মনে করেন আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেসরকারি হিসেবে আরও অনেক বেশি) যেখানে সমাজের নিচ স্তর থেকে আছে উঁচু স্তর অবধি অনেক মানুষ, সাধারন খেঁটে খাওয়া রিক্সা পোলার, শ্রমিক, দিন মজুর, পোষাক কর্মী, নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্য, বিজিবি, ডাক্তার,নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কর্মচারী, ব্যাংকারসহ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, সরকারের উচু স্তরের কর্মচারী, শিল্পপতি, সংসদ সদস্য কেহ বাদ পড়েনি এই মৃত্যুর মিছিল থেকে।
## ভেন্টিলেটরের অভাবে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি পরিবারের করুন অবস্থা ও এক সদস্যের মৃত্যু
আমার মনে হয় ভেন্টিলেটর নিয়ে সবচেয়ে হ্রদয়বিদারক ঘটনাটা ঘটেছে আমাদের দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের পরিবারে। বলছিলাম ভেন্টিলেটর নিয়ে করোনা আক্রান্ত এস আলম পরিবারের মর্মান্তিক ঘটনার কথা। ঘটনাটি ঠিক নিম্নরকমঃ
করোনায় শিল্পপতি পরিবারের গুরুত্বপুর্ণ পাঁচ ছয়জন আক্রান্ত। সবাই বাসায় আইসোলেশনে ছিলেন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছোট ভাইকে তীব্র শ্বাসকষ্টে্র জন্য চট্রগ্রামের একটা বেসরকারী হাসপাতালে আইসিইউ বেডে নেয়া হয় পূর্বেই। ঘন্টা কয়েকের ব্যবধানে বড় ভাইয়ের শ্বাসকষ্ট চরমে উঠে। বাঁচার জন্য ছটপট করছেন তিনি। পরে উনাকেও নেওয়া হল ছোট ভাইয়ের ভর্তিকৃত হাসপাতালে একটু স্বস্তি দেবার জন্য। কিন্তু হাসপাতালের দশটি আইসিইউ-ভেন্টিলেশনের সবগুলোতেই রোগীতে পরিপূর্ণ। সবারই একই অবস্থা-ভয়াঙ্কর শ্বাসকষ্ট। সবাই বাঁচার জন্য, স্বস্তিতে নিশ্বাস নেবার জন্য একটু অক্সিজেন চান। সবাই একটু শান্তিতে থাকতে চান এই দুঃসময়ে। শান্তিতে বাঁচতে চান কিংবা মরলেও শান্তিতে মরতে। কার মুখ থেকে ভেন্টিলেশন খুলে কার মুখে দেবেন! সবারই যে বাঁচার আকুতি!! সবারই যে আকুলি বিকুলি!!!
বড় ভাইয়ের কষ্ট বাড়ছে দ্রুত গতিতে। এক একটি শ্বাস যেন হাজার মন ওজনের এক একটি পাথর। রিং বসানো হার্ট এত ভার সইবে কি করে!!! এক পর্যায়ে ছোট ভাইয়ের ভেন্টিলেশন খুলে দেয়া হলো বড় ভাইকে। তিনি কিছুটা শান্তি পেলেন। কিন্তু পূর্বের ভয়াল যে ধকল গেছে উনার উপর দিয়ে তা আর কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। মারা গেলেন নিমিষেই। ছোট ভাইয়ের ভেন্টিলেটর খুলে দিয়েও বড় ভাইকে আর বাঁচানো গেলনা।-এটি কোন সাধারণ মানুষের ঘটনা নয় এবং কল্প কথাও নয়। দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপ এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের বড় এবং ছোট দুই ভাইয়ের বেলায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা। অবশেষে বড় ভাই নিস্তেজ হয়ে গেলেন, চলে গেলেন চিরতরে না ফেরার দেশে। ছোট ভাইকে আবার আইসিইউ নিয়ে ভেন্টিলেটর দেয়া হয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, সময়মতো আইসিইউ-ভেন্টিলেশন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে ঘটনাটি ভিন্ন আংগিকে লেখা হতো! কিন্তু চট্টগ্রামে আইসিইউ ভেন্টিলেশন সুবিধা পর্যাপ্ত নেই। এস আলম গ্রুপের পরিচালকের বেলায় সেদিন যা ঘটলো ঠিক একই ঘটনা কাল আমি, আপনি বা অন্য কোন শিল্পপতির বেলায় ঘটতেই পারে। ঘটতে পারে দেশের গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিবর্গদের ক্ষেত্রেও। ভয়াল সেই দিনটি কেবলই ধেয়ে আসছে আনমনে, বাজছে মনে নিরন্তর করুন সুর!
দেশের শীর্ষ স্থানীয় এস আলম গ্রুপ চাইলে চোখের পলকে কয়েক হাজার আইসিইউ-ভেন্টিলেশন বেড কিনতে পারে বা পারতো। অথবা রাতারাতি চীনের মত পাঁচ হাজার শয্যাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক হাসপাতাল করে দিতে পারে বা পারতো। অথচ একটি মাত্র ভেন্টিলেটরের অভাবে নিদারুন কষ্ট নিয়ে তাদের পরিবারের একজন সম্মানীত অভিভাবক এভাবে চলে যাবেন তা গুনাক্ষরেও কেহ চিন্তা করেছেন কখনও? শিল্পপতি পরিবারের হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক, ব্যাংক ব্যালেন্স, পাওয়ার প্ল্যান্ট, গাড়ি, বাড়ি সহায় সম্পদ সবই যেন মুল্যহীন হয়ে গেল নিমিষেই। চোখের পলকে স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। এই শিল্পপতি পরিবার কস্মিনকালেও চিন্তা করেছিলেন এরকম একটা ট্রাজেডি রচিত হবে!!?
পরিশেষে একটা কথা স্মরন করিয়ে দিতে চাই, সেদিন যদি আমরা সঠিকভাবে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা অনুমান করতে পারতাম এবং ভেন্টিলেটর দেশীয়ভাবে সত্যিকার অর্থে তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করে, দেশের প্রতিটি হাসপাতালে স্বল্প মূল্যে সরবরাহ করতে পারতাম, তাহলে আজকের এই করুন ইতিহাসের স্বাক্ষী হবার সম্ভাবনা হয়ত থাকতনা। এভাবে সবকিছু নিয়তির উপর ছেড়ে দিতে হতো না। তারপরও বলব, মহান আল্লাহর ইচ্ছের বাইরে কিছু তো ঘটেনা, হয়ত আল্লাহর ইচ্ছে ছিল তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায় মনে অগোছরে-করোনা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমরা কতটুকু সচেতন ছিলাম? সামাজিক দূরত্ব ঠিকভাবে বজায় রেখেছি? মাস্ক, গ্লভস পরিধান ও আত্মরক্ষামূলক কাজ করেছি? হোম কোয়ারান্টাইন ও লক ডাউন সঠিক নিয়মে মেনে চলেছি এবং সাবান দিয়ে বিশ সেকেন্ড হাত ধোয়াসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুন আমরা মেনে চলেছি ? রাষ্ট্র কি তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? রাষ্ট্র করোনার জন্য সচেতনতা, সঠিক ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা উপযুক্ত সময়ে গ্রহন করতে পেরেছ? আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা মহামারী মোকাবেলার জন্য আসলে সঠিকভাবে প্রস্তুত ছিল? ভেন্টিলেটর দেশীয় বাজারে তৈরি করার মত অবস্থা আসলেই ছিল ? এরুপ বিবিধ প্রশ্ন মন মন্দিরে হাজার বার ঘুরপাক খেয়ে চলছে নিয়ত!
লেখকঃ প্রেসিডেন্ট বিএমএসএফ ( বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম) উখিয়া উপজেলা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া।