আইকন ডেস্কঃ
যখন আমি প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বুড়ো হয়ে যাবো, একেবারে থুত্থুরে বুড়ো, তখন কি বাবা তুই আমার পাশে থাকবি ? একটু ধৈর্য ধরে রাখবি তো আমার ওপরে ? ধর, যদি তোর দামী কাচের বাসনটা আমার হাত থেকে পড়ে যায় হঠাৎ ? কিংবা, তরকারির বাটিটা উল্টে ফেলি টেবিলের উপরে ? আমি যে তখন অত ভালো দেখতে পাবো না রে ! আমাকে তুই চিৎকার করে বকিস না প্লিজ ! বুড়োরা যে সারাক্ষণ নিজেদেরই অবহেলিত মনে করতে থাকে, তুই জানিস না ? তুই আর বউ মা তখন খুবই স্ট্যান্ডার্ড লাইফ এনজয় করবি তখন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন হবে অভাবনীয়! হয়ত মানুষ আরো বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠবে! পুরো পৃথিবীটাই তখন রোবোটিক হয়ে উঠবে! কিন্তু পারিবারিক বন্ধন অনেকটাই শীতল হয়ে পড়বে, আজকের পৃথিবী তখন নব উদ্যমে সৃষ্টি হবে। যদি আল্লাহ চাহেন আমি ও তোর মা তোর সাথে থাকতে পারার সৌভাগ্য হলে তখনই আমার এই অব্যক্ত কথাগুলো হয়ত কিছুটা আওড়াবার সুযোগ সৃষ্টি হবে, হয়ত! এর পুর্বে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিলে কথাগুলো ঠিকই অনর্থ ছাড়া অন্য কিছু নয়!
বলছিলাম কি! আমি একদিন আর কানে শুনতে পাবো না, একবারে বুঝে ফেলবো না তুই কী বলছিস, তাই বলে আমাকে ‘বধির’ ডাকিস না ! লাগলে না হয় আরেকটাবার কষ্ট করে কথাটা বলিস, না হয় লিখেই দিলি কাগজে কলমে। আমাকে ক্ষমা করিস রে, আমি যে প্রকৃতির নিয়মে বুড়িয়ে গেছি , কি করবো বল ?
আর যখন আমার হাঁটু কাঁপবে, পা দুটো শরীরের ভার আর বইতে চাইবে না, তুই একটু ধৈর্য ধরে আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবি না, বল ? যেমন করে প্রথম হাঁটতে শিখেছিলি আমার পায়ের পাতার উপরে দাঁড়িয়ে, তেমনি করে ?
কখনো কখনো আমি ভাঙা রেকর্ড প্লেয়ারের মত বকবক করেই যাবো, তুই একটু শুনিস কষ্ট করে। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করিস না প্লিজ, আমার বকবকানিতে অধৈর্য হয়ে যাস না রে। তোর মনে আছে, ছোট্টবেলায় তুই একটা বেলুনের জন্য কেমন ঘ্যানঘ্যান করেই যেতিস আমার কানের কাছে, যতক্ষণ না তোকে আমি সেটা কিনে দিতাম , মনে পড়ছে তোর ?
আমার গায়ের গন্ধটাকেও ক্ষমা করে দিস পারলে। আমার শরীরে বুড়োটে গন্ধ জন্মাচ্ছে! স্নান করার জন্য জোর করিস না তখন। আমার শরীরটা যে বড্ড দুর্বল থাকবে, একটু জল লাগলেই ঠাণ্ডা লেগে যাবে ! আমাকে দেখে নাক শিঁটকাস না প্লিজ ! মনে আছে, ছেলেবেলায় তোর পেছনে আমি ছুটতাম আর ছুটতাম, তুই স্নান করতে চাইতিস না বলে ? তুই বিশ্বাস কর, বুড়োদের এমনই হয়, হয়তো তুই বুঝবি একদিন, হয়তো… একদিন !
হাতে যদি সময় থাকে, আমরা একসাথে গল্প করবো, কেমন ? হোক না মাত্র কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। আমি তো সারাদিন একাই থাকি, আমার সময় যে একা ফুরোয় না রে ! আমি জানি, তুই তোর কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকবি, আমার বুড়ো হয়ে যাওয়া গল্পগুলো তোর শুনতে ভালো না লাগলেও একটু আমার পাশে থাকিস ? তোর মনে আছে, কত কতবার তোর ছোট্ট পুতুলের গল্প আমি শুনতাম, শুনেই যেতাম ? আর তুই বলেই যেতিস, বলেই যেতিস… আমিও তো তোকে অনেক গল্প বলতাম , মনে পড়ে তোর ?
একদিন আসবে, বিছানায় পড়ে থাকবো, আমার একটু যত্ন নিবি সেদিন ? আমাকে ক্ষমা করে দিস যদি ভুল করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলি, যদি চাদরটা নোংরা করে দেই, আমার শেষ সময়টায় শুধু আমাকে ছেড়ে দূরে থাকিস না প্লিজ!
যখন সময় হবে, আমার হাতটা তোর মুঠোয় পুরে নিস। আমাকে একটু সাহস দিস যেন মৃত্যুকে আমি নির্ভয়ে আলিঙ্গন করতে পারি !
আর ভাবিস না, যখন আমি আমার মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে যাবো, মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হবে, উনাকে আমি তাঁর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলবো, যেন তোর মঙ্গল করেন, কারণ তুই আমাকে ভালোবেসেছিলি, আমার বুড়ো সময়গুলোতে আমার যত্ন নিয়েছিলি !
তোকে অনেক অনেক ভালোবাসি রে , তুই ভালো থাকিস …. এটা ছাড়া আর কি বলার বা দেওয়ার আছে রে!
সুত্রঃ এক ভবিষ্যৎ ভাবুক পিতার একান্ত ভাবনাঃ