এম আর আয়াজ রবি।
প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) আইনের ২(৮) ধারায় বলা হয়েছে, “সাংবাদিক অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি যিনি প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার বা বার্তা সংস্থার কাজে একজন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক হিসেবে নিয়োজিত আছেন অথবা উক্ত মিডিয়া বা সংবাদ সংস্থার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, উপ-সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক, ফিচার লেখক, রিপোর্টার, সংবাদদাতা, কপিরাইটার, কার্টুনিস্ট, সংবাদচিত্র গ্রাহক, সম্পাদনা সহকারী এবং সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত কোনো পদকধারীগণও ইহার সাংবাদিক হিসেবে গণ্য হবে”।
সাংবাদিকতা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান—বিজ্ঞান চর্চা ও মানবিক চেতনা বিকাশের কেন্দ্র এবং নীতি নৈতিকতা, দায়—দায়িত্ব ও বুদ্ধি—বিবেকের আধার। তাই সৃজনশীল গণমাধ্যম ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে সংবাদপত্র অগ্রগণ্য। তবে সবচে’ ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাহসী, সংবেদনশীল ও নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ ও গণসম্পৃক্ত সার্বক্ষণিক পেশা সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল দল নিরপেক্ষ সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদপত্র যতবেশি নিরপেক্ষ হবে এবং সাংবাদিকরা যত বেশি নির্ভীক ও সৎ হবে দেশ ও জাতির তত বেশি মঙ্গল হবে। আর সেজন্যই তো সাংবাদিকদের সমাজের অতন্দ্র প্রহরী বা ‘গেট কিপারস’ বলা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্যালারিতে উপস্থিত সংবাদ প্রতিনিধিদের লক্ষ্য করে রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বোঝাতে এডমন্ড বার্ক সংবাদপত্রকে ‘ফোর্থ স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমাদের দেশেও রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের পরে সাংবাদিকতাকে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তবে আভিধানিকভাবে সংবাদপত্রের এসব বৈশিষ্ট্য হলেও, অনেক সংবাদপত্র ও সাংবাদিক নানা স্বার্থে উল্টাপথে হাঁটেন বা অপসাংবাদিকতায় মেতে ওঠেন, এমন প্রমাণও ভুরিভুরি।
আসলেই সাংবাদিকতা একটি কঠিন ও মহান পেশা। এ পেশাকে মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এ পেশার লোকজনকে অনেকেই ‘জাতির বিবেক’ বলে অভিহিত করে থাকেন। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতাকে সাবলীলভাবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। শুধু দেশ, জাতি নয়, বিশ্ব উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা দেশে দেশে স্বীকৃত। সাধারণ জনগণের এ মহান পেশার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। কারণ এ সমাজের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরবারির ন্যায় কলমের শানিত অস্ত্র একমাত্র সাংবাদিকরাই ধরে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের ঘটনা প্রবাহের সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি পত্রিকার মাধ্যমে দেশের বর্তমান অবস্থা ও করণীয় বিষয়ও অহরহ দিক-নির্দেশনা তাঁরাই দিয়ে যাচ্ছেন। তাই তো প্রকৃত সাংবাদিকের কোন স্থান,কাল ও পাত্র নেই। তারা প্রত্যেক সমাজ, দেশ ও জগৎ সভার এক একজন পরীক্ষক, নিরীক্ষক ও বিশ্লেষক। দেশে দেশে সামাজিক অনাচার ও বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, মবানবতার অতন্দ্র প্রহরী সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির শেষ ভরসা। তাদেরকে সমাজের ‘তৃতীয় চক্ষু’ বলে অভিহিত করা হয়। তাই সাংবাদিকরা সব সময় তৃতীয় চোখ হয়ে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদ্ঘাটনে পারঙ্গম হবে এটাই পাঠক সমাজ আশা করেন।
সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা এসব কিছু মোকাবিলা করেই তাদের পেশার সম্মানকে অমলিন করে রাখছেন। এ পেশা মূলতঃ শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, দেশ-জাতি এবং মানুষ ও মানবতার কল্যাণে সেবার মাধ্যমও বটে। তাই এই মহান পেশার সেবকদের ওপর যখন জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে তখন আমরা ব্যথিত হই। তবে আমরা এর চাইতে বেশি ব্যথিত ও মর্মাহত হই তখনই, যখন দেখি কোন সাংবাদিক ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, অহংকার কিংবা প্রলোভনের কারণে সাংবাদিকতার নিয়ম, নৈতিক নীতিমালা এবং কর্তব্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে একপ্রকার আপোষকামীতা নীতিতে অগ্রসর হয়।
এ মহান পেশা ক্রমান্বয়ে কলুষিত হয়ে আসছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনতার নামে এক ধরনের অপসাংবাদিকতার প্রয়োগ ঘটানোর মাধ্যমে। ঠিক যেন আলোর পিছনে অন্ধকার। উন্নয়নশীল দুনিয়ায় ক্ষুধা-দারিদ্র্যতার কারণে সমাজ ও রাজনীতি অস্থিতিশীল থাকায় দুর্নীতি শক্ত শেকড়ে বিশাল বটবৃক্ষের ন্যায় ক্রমশ: বিস্তৃত হওয়ায় সৎ, বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার বিপরীতে পেশীশক্তিধারী অপসাংবাদিকদের দাপট-দৌরাত্ম্য এখন উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা বাংলাদেশে এখন অপ্রতিরোধ্য!
ইদানিংকালে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অর্থলোভী, স্বার্থান্বেষী, টাউট-বাটপার, ধামাধরা, একচোখা, পক্ষপাত দোষে দুষ্ট, আপোষকামী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুষ্টক্ষতদের বিচরণ যথেষ্ট পরিমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে এ মননশীল কর্মচর্চায়। এসব অনৈতিক তথাকথিত সাংবাদিক ব্যাখ্যার স্থলে অপব্যাখ্যা, ন্যায়কে অন্যায়ের রূপ দান, সত্যকে ঢাকার জন্যে অসত্যের আবরণ ফেলাকে মনে করে থাকে সাংবাদিকতার বিজ্ঞতা। অনেকেই তথাকথিত প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে নামে বেনামে গলায় কার্ড ঝুলিয়ে নিজকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে সিদ্ধহস্ত প্রদর্শন করছে! সংবাদ লেখার যোগ্যতা, দক্ষতা নেই অথচ সাংবাদিক। সম্পাদনা করার মেধা, প্রজ্ঞা নেই অথচ সম্পাদক! এ হচ্ছে সংবাদপত্র জগতের একটি ভয়ংকর চিত্র। আবার কিছু তথাকথিত সম্পাদক ও প্রকাশক নামীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে যাদের কোন ধরনের সাংবাদিকতা করার যোগ্যতা ও গ্রহনযোগ্যতা নেই, তাদেরকে বিভিন্ন নামে কার্ড বিতরণ করে সাংবাদিক বানিয়ে দিচ্ছে এগুলো থেকে অপসাংবাদিকতা বিস্তার লাভ করেছে চারদিকে। আর এই অপসাংবাদিকতার বিকৃত আরেকটি প্রচলিত শব্দ হচ্ছে হলুদ সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকতা কোন সাংবাদিকতা নয়, সেটাকে সাংবাদিকতার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। তাই হলুদ সাংবাদিকতা একটি বিকৃতি ও সাংবাদিকতার অপব্যবহার।
হলুদ সাংবাদিকতার জন্য দায়ী মূলতঃ এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সংবাদপত্র। তবে এর সাথে রয়েছে দেশ ও সমাজের সার্বিক অবক্ষয় । এদের কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাংবাদিক মাত্রই সাধারণ মানুষের কাছে পরিণত হয়েছে এক ভীতিকর প্রাণীতে। মানুষ সাংবাদিক দেখলেই ‘সাংঘাতিক’ বলে আঁৎকে উঠে। কারণ হচ্ছে লেখার স্বাধীনতার সুবাদে এরা সাংবাদিকতার ন্যূনতম বিধি-বিধান আর নীতি-জ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে- এ কেমন সাংবাদিকতা? সত্যকে গোপন করে মিথ্যাকে ফুলিয়ে রং লাগিয়ে প্রচার করাটা সাংবাদিকতার কোন স্তরে পড়ে কি? সংবাদ পরিবেশনায় তিলকে তাল বানানোর কেরামতি অবশ্যই সচেতন পাঠক সমাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে এটা স্বাভাবিক । অনেক সময় সাংবাদিকতার লেবাস পরে অনেকে কত যে নীচতা, হীনতা, দীনতা আর সংকীর্ণতায় আকন্ঠ নিমজ্জিত তা বলতেও লজ্জা হয়। একজন সাংবাদিক যদি এটা ভাবেন আমি সাংবাদিক, আমার হাতে কলম আছে, কাগজ আছে, তাই যা খুশি লিখবো, সবার মাথা আমি কিনে নিয়েছি এমন ভাবা ঠিক নয়। লেখার স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকার, সামাজিক অবস্থান, মান-সম্মানকে উপেক্ষা করা নয়। সংবাদপত্রের যেই স্বাধীনতা মানুষের সকল স্বার্থের পাহারাদার, তার সকল অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানকারী এবং অসহায়ের শেষ কন্ঠ, সেই পবিত্র স্বাধীনতাকে আজ ‘ভেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার’ মতো মর্মান্তিক ভূমিকার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা রাজনৈতিক দলের ওপর অসত্য তথ্য আরোপ করা হচ্ছে। ফলে অনেকে সামাজিক রাজনৈতিক বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে তা সংবাদপত্রগুলো অনেকক্ষেত্রে প্রমাণ করতে সক্ষম হচ্ছে না।
অনেকে বলছেন, সাংবাদিক কিংবা সংবাদপত্রের মালিকরা সংবাদপত্রের যে স্বাধীনতা রয়েছে, সে সুযোগের অপব্যবহার করছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের সংবাদপত্র সম্পর্কে, মানুষের বিশ্বাস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, তলানীতে ঠেকছে। যে সব সাংবাদপত্র এ ধরনের মিথ্যা, বানোয়াট কিংবা উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ পরিবেশন করে তারা প্রচলিত আইন-কানুন, সংবিধান তথা সমগ্র দেশ ও জাতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চলছেন।
এই ধরনের সাংবাদিকদের রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতা ও অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে সাংবাদিকতার মত এ মহান পেশাও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়টি সংবাদপত্র জগতের কর্ণধারদের জন্য এক অশনি সংকেত। এমন চিত্র আমরা লক্ষ্য করেছি আমেরিকার মত দেশেও। এক সময় ছিল যখন কালে-ভদ্রে মার্কিন আদালতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেও পেশাগত মর্যাদার কারণে তাদের সুনজরে দেখা হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। পেশাগত সততা ও নিষ্ঠা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এখন মার্কিন আদালতে সাংবাদিকদের আর আগের মত বিশেষ নজরে দেখা হয় না। এখন আদালতে তাদের বিচার হয় এবং শাস্তিও হয়। এই উদাহরণে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে বৈকি।
আজকাল পত্রিকার পাতাতেই সাংবাদিকের অপকর্মের কথা অন্য সাংবাদিক লিখে দিচ্ছেন এবং তা সংবাদ পত্রেই প্রকাশিত হচ্ছে। সর্ব মহল থেকে নিন্দাবাদ শুনতে হচ্ছে। এরপরও কি এদের অপকর্মের দৌরাত্ম্য কমছে? না কমেনি। তাইতো প্রয়োজন জবাবদিহিতার। ইদানীং অবশ্য সাংবাদিকদের জবাবদিহিতার কথা সচেতন মহল থেকে শোনা যাচ্ছে। মূলত: সাংবাদিকদের প্রতিদিন প্রতিনিয়তই পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। জবাবদিহি করতে হচ্ছে জনতার আদালতে। তারপরও কথা থেকেই যায়, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরা যেহেতু সমাজের দর্পন। তাই মানুষ চায় তারা সমাজের অন্যদের জন্যে উদাহরণ হবে। তারা অন্যায় করবে না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। তারা দুর্নীতি করবে না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। মানুষের এ চাওয়া পাওয়ার দুস্তর ব্যবধানের কিছুটা হলেও কমিয়ে এনে সাংবাদিকদের ‘অপকর্মের’ জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা যায় কিনা সম্ভবত ভেবে দেখার সময় এসেছে। ভবিষ্যতের জন্যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে, যারা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে আসবে, তাদের জন্য দায়িত্বশীলতার একটা বিহিত করা একান্ত প্রয়োজন। ধন্যবাদ।
লেখকঃ স্টাফ রিপোর্টার দৈনিক গণজাগরণ, ভাইস-প্রেসিডেন্ট উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া ও সাবেক প্রেসিডেন্ট-বিএমএসএফ উখিয়া উপজেলা।