এম আর আয়াজ রবি।
কিছু কিছু অপমৃত্যু মানুষকে ভাবিয়ে তোলে, করে আবেগতাড়িত, নিজের অজান্তে জন্মদেয় হাজারো প্রশ্নের অবতারণা! বলছিলাম কি নিজের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে আত্মহননে যাওয়া আবু মহসিন খানের কথা!
আবু মহসিন খান, একজন সফল চলচ্চিত্র নায়ক রিয়াজের শ্বশুর ছিলেন, একজন নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন তাতে সন্দেহের তিলমাত্র অবকাশ নেই। পৃথিবীতে ভালো-মন্দ, ন্যায়- অন্যায়, লাভ-লোকসান কি করেছেন তিনি যেমন জানতেন, তেমনি স্বয়ং মহান আল্লাহপাক ভালো জানেন! তবে এটা নিশ্চিত যে নিজের সন্তানদের তিলে তিলে সুন্দরভাবে বড় করেছেন, মানুষ করেছেন(!), পড়ালেখা শিখিয়েছেন(!), আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলেছেন। সন্তান-সন্ততি পরিবার পরিজন সুদুর বিদেশ বিভূঁই এ পাড়ি দিয়েছেন। আমার জানা মতে অষ্ট্রেলিয়ায় সবাই স্যাটল্ড/ অবস্থান করছেন। শত প্রতিকুলতার মধ্যেও পারতপক্ষে নিজের সন্তানদের নিজের কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, অভাববোধ বুঝতে দেননি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন একাকী জীবন যাপন করতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু মাঝে মধ্যে আপন ভাগ্যই বিড়ম্বনার শিকার হয়ে পড়ে! বলতে গেলেই, তারই প্রায়শ্চিত্ত করলেন নিজের লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে মাথার খুলি উড়িয়ে উপড়ে ফেলে! সেই একাকীত্ব জীবনের অবসান ঘটালেন নিজেই আত্মহননের মতো এক জটিল পাপ ও পংকিলতাকে সাথী করে, একপ্রকার পরকালীন জীবনকেও অনিশ্চিত ও দুর্বিষহ করে গড়ে তোলে!
নিশ্চয়ই তিনি প্রতিনিয়ত নিজের ভেতরে নিজেকে দাফন করে করেই এমন এক চরম সিদ্ধান্ত হাসি মুখে গ্রহণ করেছেন। ডিপ্রেশন মানুষকে চলতে চলতেই খানিক স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলে। তাদের দেখে কারও দেখার উপায় থাকে না যে, তারা কতই না কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রনা,হাজারো হতাশাকে বুকে চাপা দিয়ে দিব্যি ভাল থাকার অভিনয় করে যায়! তারা মুখ ফুটে কখনই বলবে না, আমি ভালো নেই। মিথ্যার প্রলেপের মাধ্যমে সু-চতুর অভিনয় দিয়ে তারা সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করে কিন্তু পরক্ষনেই অন্তঃদহনে নিজকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। এভাবেই তাদের সুর্যের আলোতে দিব্যি কাটিয়ে দিলেও রাতের অন্ধকারে দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়, তাদের হতাশা ও ডিপ্রেশন বাড়তে থাকে একটি নির্দিষ্ট নিক্তি স্কেলে। পারিপার্শ্বিক, নিজের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান, পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের যন্ত্রনা তাদের মস্তিষ্ককে বিকল করে দেয়। তাদের ভেতরে আটকে থাকা কষ্টগুলো নিজেকে আত্মহননের দিকে প্ররোচিত করে। আত্মহত্যা মহাপাপ ভেবেই হয়তো, তারা নিজেদেরকে মোড়াতে পারে না, দাফনের কাফনে। কিন্তুু যারা পারে তারা মুড়িয়ে দেয় নিজেকে সাদা কাফনে। প্রতিনিয়ত নিজের ও পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত সৈনিক-এসব মহসিনরা আমাদের ক্ষমা করবে কি!
মহসিন সাহেব বিশ্বাসে মুসলিম হলেও, আত্মহনন পরকালীন জীবনকে চিরস্থায়ী তুষের আগুনে পোড়াবে ( চির জাহান্নামি) সেটি হয়ত তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি! হয়ত তিনি মনে করেছেন, কলেমা পড়ে যিনি মৃত্যুবরণ করেন, তিনি জান্নাতের বাসিন্দা হবেই হবেন, এমন বদ্ধমুল ধারণা থেকেই এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন কিনা তা গবেষণার বিষয়। অথবা এমন ও হতে পারে, পৃথিবীতে তিনি যে জটিল অন্তদহনে নিঃশেষিত হচ্ছিলেন তা পরকালীন স্থায়ী কষ্টের চেয়েও উনার কাছে আরও অধিকতর কষ্টের বলে ভ্রম হচ্ছিল!ব্যক্তি মহসিন সাহেবকে এতদিন কেহ তেমন চিনতনা! চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর হলেও তেমন পরিচিতি বা সেলিব্রিটি ছিলেননা। উনার প্রতি মানুষের আগ্রহের কোন কারণও তেমন ছিল না। কিন্তু যবে না তিনি অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজে, পরিকল্পিত ভাবে, হাসতে হাসতে, কলেমা পড়তে পড়তে আত্মহননে নিজকে বিলিয়ে দেবার মর্মন্তুদ ঘটনাকে স্বাক্ষী রেখে গেছেন-তখনই তাবৎ দুনিয়ায় একটি খবরের শিরোনাম হয়ে পড়েছেন!
একটু চিন্তা করলেই মানসপটে ভেসে উঠে অনেক কিছু! কী ছিলোনা তার? স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, ধনসম্পদ, নিজের বাড়ি গাড়ি, এমনকি আত্মরক্ষার জন্য লাইসেন্স করা একটি পিস্তলও ছিল। কিন্তু তার জীবনের প্রাপ্তি কী? এতকিছু থাকতেও সে কী পেয়েছে? একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, দুশ্চিন্তা, হতাশা, ডিপ্রেশন ছিল তার নিত্যসঙ্গী!
টাকাপয়সা, বাড়ি গাড়ি আসলে মানুষকে সুখি করতে পারেনা। একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন দূর করতে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জরুরি।
বিশ্বাস করুন, আর্থিক অনাটনে থেকেও বহু পরিবারকে সুখি জীবন পার করতে দেখেছি। যারা ইসলামি ভাবধারায় জীবন গঠন করেছেন, মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।
#আল্লাহ সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুণ, আমিন।
পুনঃশ্চ-আবু মহসিন খান নিজের আত্মহননে আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনেক কিছু শিখিয়ে গেছেন।
লেখকঃ কলামিষ্ট ও মানবাধিকার কর্মী। প্রেসিডেন্ট- বাংলাদেশ জাতীয় সাংবাদিক ফোরাম ( BNJF) ও ভাইস প্রেসিডেন্ট- উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া।