এম আর আয়াজ রবি
‘সংবাদ’ যাকে ইংরেজিতে ‘News’ বলে। News এর Elaberation রুপ হচ্ছে North, East, West ও South অর্থাৎ আমাদের চতুর্পাশের অবস্থা থেকে যাবতীয় উপাদান সংগ্রহ করে, মানুষের মনে ঐ উপাদানগুলোর উপর আগ্রহ সৃষ্টি করা। News এমন একটি শব্দ, যেটা সবসময় বহুবচন অর্থে প্রকাশ পায়। এজন্য সংবাদ বিশ্লেষকরা ‘News always be new’ বলে অভিহিত করেছেন।
‘সংবাদ’ হলো চলতি ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ ও প্রকাশ, যে বিষয়ে পাঠকের চিন্তন, আগ্রহ, মনোভাব ও আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপিত করে। এ কথাটাকে অন্যভাবে বললে বলা যায়-যে ঘটনা বা ঘটনাপুঞ্জ, যেটা/যেগুলো যেকোন মাধ্যমে (ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া বা পোর্টাল/ভাচ্যুয়াল মিডিয়া) প্রকাশিত হলে, ব্যক্তি বা সমাজে যে বিভিন্ন ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সেসব ঘটনা বা ঘটনাবলীর প্রতিবেদন অবশ্যই সত্য, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ, গুরুত্বপূর্ণ এবং মানুষের মনে কৌতুহল, উদ্দীপনা, আগ্রহ জন্মায় অথবা ঘটনাগুলো থেকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম লাভ করে,তাকে খবর বা সংবাদ বলে। প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাই শুধু সংবাদ নয়। আমাদের চর্তুপার্শ্বে বিদ্যমান যে কোন সমস্যাও হতে পারে এক একটি সংবাদ।
বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংবাদকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন, সংবাদ বিশেষজ্ঞ হ্যারিস ও জিনসন বলেন, ‘সংবাদ হচ্ছে একটি ঘটনা, বিষয় বা মতামতের বিবরণ যা জনগণ আগ্রহ নিয়ে পড়ে।’ আবার নিউ ইয়র্ক সান পত্রিকার সম্পাদক চার্লস এ. ডানার মতে, ‘মানুষকে যা বিস্মিত ও অবাক করে তাই সংবাদ।’ তিনি তার এ সংজ্ঞাটির আরও উৎকর্ষ করে বলেন, ‘ইতিপূর্বে মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি অথচ সমাজে বৃহত্তর অংশকে কৌতূহলী করে তোলে, এমন যে কোনো বিষয়ই ‘সংবাদ’।
ইংরেজি ‘Journal’ ও ‘Ism’ শব্দের মিলনে ‘Journalism’ শব্দটি তৈরি। ‘Journal’ হচ্ছে কোনো কিছু প্রকাশ করা আর ‘Ism’ মানে অভ্যাস করা, অনুশীলন বা চর্চা করা। সুতরাং বলা যেতে পারে, সমাজে বিদ্যমান সামঞ্জ্যতা, অসামাঞ্জ্যতা, অভাব, অভিযোগ, আনন্দ, খুশী, সফলতা বা ব্যর্থতার ঘটনা বা দূর্ঘটনার প্রকাশ করার জন্য যে চর্চা বা অনুশীলন করা হয়, তা-ই সাংবাদিকতা বা জার্নালিজম। সাদামাটা ও সংকীর্ণ ভাষায়, যিনি সংবাদপত্র বা ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য সংবাদ সংগ্রহ করেন, যাচাই-বাছাই করেন এবং বস্তুনিষ্ট ও নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করেন, তাই-ই সাংবাদিকতা। তবে আধুনিক সাংবাদিকতার বিশাল আঙ্গিনায় সাংবাদিকতাকে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বেঁধে দেওয়া যায় না
সাধারণভাবে যিনি সংবাদপত্র বা বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করেন, সত্যমিথ্যা যাচাই বাছাই করেন, লিখেন, প্রকাশ করেন তাকেই সাংবাদিক বলে অভিহিত করা হয়। তবে বর্তমান সময়ের আধুনিক সাংবাদিকতার বিশাল পরিসরে সাংবাদিককে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে দেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়। এখন সংবাদপত্রের ধরনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি সাংবাদিকদের কাজের পরিধিতেও এসেছে পরিবর্তন । সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। ‘শতভাগ সঠিক সংবাদ প্রচারের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ ঘটনার সঠিক সংবাদ জানতে চায়। সত্য লুকানোর মধ্যে ঘটনার প্রতিকার হয় না। সঠিক ও সৎ সাংবাদিকতা সমাজ বদলে দিতে পারে’।
প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) আইনের ২(৮) ধারায় বলা হয়েছে, “সাংবাদিক অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি যিনি প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার বা বার্তা সংস্থার কাজে একজন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক হিসেবে নিয়োজিত আছেন অথবা উক্ত মিডিয়া বা সংবাদ সংস্থার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, উপ-সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক, ফিচার লেখক, রিপোর্টার, সংবাদদাতা, কপিরাইটার, কার্টুনিস্ট, সংবাদচিত্র গ্রাহক, সম্পাদনা সহকারী এবং সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত কোনো পদকধারীগণও ইহার সাংবাদিক হিসেবে গণ্য হবে”।
সাংবাদিকতা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান—বিজ্ঞান চর্চা ও মানবিক চেতনা বিকাশের কেন্দ্র এবং নীতি নৈতিকতা, দায়—দায়িত্ব ও বুদ্ধি—বিবেকের আধার। তাই সৃজনশীল গণমাধ্যম ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে সংবাদপত্র অগ্রগণ্য। তবে সবচে’ ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাহসী, সংবেদনশীল ও নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ ও গণসম্পৃক্ত সার্বক্ষণিক পেশা সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল দল নিরপেক্ষ সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। সংবাদপত্র যতবেশি নিরপেক্ষ হবে এবং সাংবাদিকরা যত বেশি নির্ভীক ও সৎ হবে দেশ ও জাতির তত বেশি মঙ্গল হবে। আর সেজন্যই তো সাংবাদিকদের সমাজের অতন্দ্র প্রহরী বা ‘গেট কিপারস’ বলা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্যালারিতে উপস্থিত সংবাদ প্রতিনিধিদের লক্ষ্য করে রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বোঝাতে এডমন্ড বার্ক সংবাদপত্রকে ‘ফোর্থ স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমাদের দেশেও রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বা শাসন বিভাগের পরে সাংবাদিকতাকে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তবে আভিধানিকভাবে সংবাদপত্রের এসব বৈশিষ্ট্য হলেও, অনেক সংবাদপত্র ও সাংবাদিক নানা স্বার্থে উল্টাপথে হাঁটেন বা অপসাংবাদিকতায় মেতে ওঠেন, এমন প্রমাণও ভুরিভুরি।
আসলেই সাংবাদিকতা একটি কঠিন ও মহান পেশা। এ পেশাকে মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এ পেশার লোকজনকে অনেকেই ‘জাতির বিবেক’ বলে অভিহিত করে থাকেন। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতাকে সাবলীলভাবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। শুধু দেশ, জাতি নয়, বিশ্ব উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা দেশে দেশে স্বীকৃত। সাধারণ জনগণের এ মহান পেশার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। কারণ এ সমাজের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরবারির ন্যায় কলমের শানিত অস্ত্র একমাত্র সাংবাদিকরাই ধরে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের ঘটনা প্রবাহের সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি পত্রিকার মাধ্যমে দেশের বর্তমান অবস্থা ও করণীয় বিষয়ও অহরহ দিক-নির্দেশনা তাঁরাই দিয়ে যাচ্ছেন। তাই তো প্রকৃত সাংবাদিকের কোন স্থান,কাল ও পাত্র নেই। তারা প্রত্যেক সমাজ, দেশ ও জগৎ সভার এক একজন পরীক্ষক, নিরীক্ষক ও বিশ্লেষক। দেশে দেশে সামাজিক অনাচার ও বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, মবানবতার অতন্দ্র প্রহরী সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির শেষ ভরসা। তাদেরকে সমাজের ‘তৃতীয় চক্ষু’ বলে অভিহিত করা হয়। তাই সাংবাদিকরা সব সময় তৃতীয় চোখ হয়ে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদ্ঘাটনে পারঙ্গম হবে এটাই পাঠক সমাজ আশা করেন।
সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা এসব কিছু মোকাবিলা করেই তাদের পেশার সম্মানকে অমলিন করে রাখছেন। এ পেশা মূলতঃ শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, দেশ-জাতি এবং মানুষ ও মানবতার কল্যাণে সেবার মাধ্যমও বটে। তাই এই মহান পেশার সেবকদের ওপর যখন জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে তখন আমরা ব্যথিত হই। তবে আমরা এর চাইতে বেশি ব্যথিত ও মর্মাহত হই তখনই, যখন দেখি কোন সাংবাদিক ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, অহংকার কিংবা প্রলোভনের কারণে সাংবাদিকতার নিয়ম, নৈতিক নীতিমালা এবং কর্তব্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে একপ্রকার আপোষকামীতা নীতিতে অগ্রসর হয়।
এ মহান পেশা ক্রমান্বয়ে কলুষিত হয়ে আসছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনতার নামে এক ধরনের অপসাংবাদিকতার প্রয়োগ ঘটানোর মাধ্যমে। ঠিক যেন আলোর পিছনে অন্ধকার। উন্নয়নশীল দুনিয়ায় ক্ষুধা-দারিদ্র্যতার কারণে সমাজ ও রাজনীতি অস্থিতিশীল থাকায় দুর্নীতি শক্ত শেকড়ে বিশাল বটবৃক্ষের ন্যায় ক্রমশ: বিস্তৃত হওয়ায় সৎ, বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার বিপরীতে পেশীশক্তিধারী অপসাংবাদিকদের দাপট-দৌরাত্ম্য এখন উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা বাংলাদেশে এখন অপ্রতিরোধ্য!
ইদানিংকালে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অর্থলোভী, স্বার্থান্বেষী, টাউট-বাটপার, ধামাধরা, একচোখা, পক্ষপাত দোষে দুষ্ট, আপোষকামী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের দুষ্টক্ষতদের বিচরণ যথেষ্ট পরিমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে এ মননশীল কর্মচর্চায়। এসব অনৈতিক তথাকথিত সাংবাদিক ব্যাখ্যার স্থলে অপব্যাখ্যা, ন্যায়কে অন্যায়ের রূপ দান, সত্যকে ঢাকার জন্যে অসত্যের আবরণ ফেলাকে মনে করে থাকে সাংবাদিকতার বিজ্ঞতা। অনেকেই তথাকথিত প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে নামে বেনামে গলায় কার্ড ঝুলিয়ে নিজকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে সিদ্ধহস্ত প্রদর্শন করছে! সংবাদ লেখার যোগ্যতা, দক্ষতা নেই অথচ সাংবাদিক। সম্পাদনা করার মেধা, প্রজ্ঞা নেই অথচ সম্পাদক! এ হচ্ছে সংবাদপত্র জগতের একটি ভয়ংকর চিত্র। আবার কিছু তথাকথিত সম্পাদক ও প্রকাশক নামীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে যাদের কোন ধরনের সাংবাদিকতা করার যোগ্যতা ও গ্রহনযোগ্যতা নেই, তাদেরকে বিভিন্ন নামে কার্ড বিতরণ করে সাংবাদিক বানিয়ে দিচ্ছে এগুলো থেকে অপসাংবাদিকতা বিস্তার লাভ করেছে চারদিকে। আর এই অপসাংবাদিকতার বিকৃত আরেকটি প্রচলিত শব্দ হচ্ছে হলুদ সাংবাদিকতা। হলুদ সাংবাদিকতা কোন সাংবাদিকতা নয়, সেটাকে সাংবাদিকতার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। তাই হলুদ সাংবাদিকতা একটি বিকৃতি ও সাংবাদিকতার অপব্যবহার।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট-উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া এবং সভাপতি-বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) উখিয়া উপজেলা শাখা।
