-জেসমিন প্রেমা
জাফর ভাই, প্রয়াত ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী একজনই জন্মেছিলেন বাংলাদেশে, যার কাছে অনেকবেশী মূল্য ছিল সাধারণ মানুষের। খুব কাছ থেকে তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। যিনি ক্ষমতাবান মানুষকে উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষকেও কিভাবে মূল্য দিতে হয় তা দেখিয়ে গেছেন।
১৯৯৮ ইং সালে ঢাকার আশপাশ বন্যায় ভেসে যায়। সেই সময় আমি একজন তরুণী, কাজ করছিলাম স্কাসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বানভাসী মানুষের পাশে দাড়াবো, তাদেরকে ত্রাণ দেবো, এ লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করি। এরই মধ্যে ফখরুল ফেরদৌস ভাই ডিসিআই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, যিনি জাফর ভাইয়ের বন্ধু। ফেরদৌস ভাই বললেন বানভাসীদের জন্য জাফর ভাইয়ের গণস্বাস্থ্য ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থাকে। আপনি জাফর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি ফখরুল ভাই কে বললাম ভাই; জাফর ভাই তো আমাকে চিনেন না। আপনি যদি একটু বলে দিতেন ভালো হতো। পরের দিন ফখরুল ভাই ফোন করলেন, বললেন প্রেমা, জাফর ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে আপনার সংস্থার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, আপনি অসহায় মানুষদের সহায়তায় যত প্রয়োজন ত্রাণ আনতে পারেন সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে। কিন্তু গাড়ি ভাড়া আপনার নিজের। আমি ঠিক পরের দিনই একটি গাড়ি ভাড়া করে সাভারে যাই, গাড়ি ভর্তি করে রুটি, পাউরুটি, বন নিয়ে আসি। তারপর সেই খাবার মতিঝিল টিএন্ডটি আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে বিতরণ করি। তারপর যখন বানভাসীদের জন্য চাল, ডাল, তেল এরকম একটি প্যাকেজ তৈরি হয় তখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে জাফর ভাইয়ের সাথে বৈঠকে ফখরুল ভাই, ফেরদৌস ভাই, শফি ভাই ও দুলাল ভাই( নির্বাহী পরিচালক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র) ছিলেন। চার জন মিলে এই মিটিংয়ে এক হাজার পরিবারের জন্য ত্রাণ বরাদ্দ হয় স্কাসের নামে। স্কাস এবং আমার নাম আসার কারণে জাফর ভাই জানতে চাইলেন আমার সম্পর্কে এবং জাফর ভাই আমার নাম শুনে আমি বাঙালি কিনা এটাও জানতে চাইলেন? সে কারণে উনি আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন। ফখরুল ফেরদৌস ভাই মিটিং শেষে আমাকে ফোন দিলেন, বললেন জাফর ভাই আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। তারপরের দিন বিকাল চার টায় সময় নিলাম জাফর ভাইয়ের কাছে থেকে। পরের দিন বিকাল চারটা বাজার আগেই আমি পৌঁছে গেলাম ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। আমি গিয়ে দেখি একজন জুনিয়র ডক্টর এর সাথে জাফর ভাই মিটিংয়ে আছেন। বাইরে অপেক্ষা করছেন বেগম রওশন এরশাদ এবং রওশন এরশাদের ছোট ভাই। ৩০ মিনিট পর জাফর ভাই মিটিং শেষ করে ডাক্তারের সাথে বের হয়ে আসলেন। রওশন এরশাদ দাঁড়িয়ে বললেন, জাফর ভাই আমি এসেছি আপনার সাথে কথা বলতে। জাফর ভাই উত্তরে বললেন, আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ওনাকে (আমাকে দেখিয়ে) আমার টাইম দেওয়া ছিল আগে থেকেই। রওশন এরশাদ বললেন আমাকে বসতে হবে? জাফর ভাই উত্তরে বললেন; আমার কাছে সব মানুষের মর্যাদা সমান। তাছাড়া ওনাকে আমি নিজেই সময় দিয়েছি। তারপর জাফর ভাইয়ের সাথে আমার ৩০ মিনিটের বৈঠক হয়। আমার কাছে জাফর ভাইয়ের প্রশ্ন ছিল? আমি কেন এই সেক্টরে আসলাম? আমি অন্য কিছুও করতে পারতাম। উনি বোঝার চেষ্টা করছিলেন সত্যিকার অর্থে আমি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি কিনা। জাফর ভাই যখন জানলেন আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বললেন যাও, কাজ করো সমাজ ও দেশের মানুষের জন্য এবং এভাবে নিজের জায়গা তৈরি করো। সত্যিকার অর্থে সেদিন থেকে জাফর ভাইয়ের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় সাধারণ মানুষকে এতো ভালবাসা। সকল মানুষের সমান মর্যাদা দিতে গিয়ে রওশন এরশাদের মতো বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন ক্ষমতাধর নারীকে বসিয়ে রেখে আমাকে সময় দেওয়া এসবই ওইসময়ে আমাকে দারুণ ভাবে আলোড়িত করেছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি সেই দিন বুঝতে পেরেছিলাম জাফর ভাই কত বড় মাপের একজন মানুষ। তারপর জাফর ভাই পিএইচএম স্বাস্থ্য আন্দোলন সংগঠনে আমাকে ডেকে নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটিতে ঢুকালেন। তারপর থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে জাফর ভাইয়ের সাথে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, বৈঠক হয়েছে। যতবার দেখেছি আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক এই মানুষটাকে জেনেছি, অবাক হয়েছি, আর শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়েছি। অনেক বড় মাপের একজন মানুষ হয়েও কিভাবে সবসময়ই সাধারণ মানুষকে নিয়ে ভাবতেন, ভালোবাসতেন এবং তাদের দুঃখ কস্ট মোচনের চেষ্টা করতেন। ওইসময় এডাব ভেঙ্গে এফএনবি তৈরি হয়। আবেদ ভাইয়ের নেতৃত্বে এফএনবি’র কমিটি গঠন করা হয়। আর নির্বাহী কমিটিতে আমাকেও রাখা হয়।
আমি খুব সৌভাগ্যবান, কারণ তরুণ বয়সে স্কাসের জন্ম লগ্ন থেকেই বাংলাদেশের এনজিও নীতি নির্ধারকদের সাথে আমার সরাসরি একসাথে, একটেবিলে বসে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। যাদের মধ্যে ছিলেন জাফর ভাই, আবেদ ভাই, রাশেদা কে চৌধুরী আপা। স্মৃতিগুলো আমাকে সবসময় নাড়া দেয়।
খুব কম বয়স থেকেই আমি জাফর ভাইসহ দেশের বড় বড় ভালো মানুষ গুলোর স্নেহ পেয়েছি। আজ জাফর ভাই নেই, আবেদ ভাইও চলে গেছেন আমিও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবো, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনন্তের যাত্রায়। তাই বেঁচে থাকতেই দেশের উন্নয়নে কাজ করে যেতে চাই। আমাকে এই পর্যন্ত কখনোই লোভ স্পর্শ করতে পারে নাই। সবাই দোয়া করবেন যেন, আমৃত্যু এভাবেই বাঁচতে পারি সবার সম্মান ও আস্থা নিয়ে।
সদ্য প্রয়াত জাফর ভাইসহ দেশের উন্নয়নের বীর সৈনিকদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
লেখিকাঃ স্কাস চেয়ারম্যান ও নারী নেত্রী