।। এম আর আয়াজ রবি।।
দিন যতই যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক অপরাধপ্রবণতা ততই বাড়ছে। মাদক, ইয়াবা, খুন, আধিপত্য বিস্তার, ডাকাতি, অপহরণ, সমুদ্র পথে জোরপুর্বক মালয়েশিয়া নেবার কথা বলে মুক্তিপণ আদায়, টার্গেট কিলিংস, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিরাতেই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে তারা। বিশেষ করে ইয়াবা,মাদক ব্যবসার বিস্তার ও বিবদমান সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, প্রত্যাবাসনের পক্ষ বিপক্ষ দলের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিরাতে চলে সশস্ত্র মহড়া। তাছাড়া মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও বাইরে ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিবদমান গ্রুপের মধ্যে বিরোধ, প্রত্যাবাসনের পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে রশি টানাটানির জের, মাদকের টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা ইস্যুকে কেন্দ্র করে চলছে গুম,খুন, অপহরণ, রোহিঙ্গা নেতা ( মাঝি) হত্যার মিশন।
২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট তারিখে পার্শ্ববর্তী মায়ানমার রাষ্ট্র থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা মানবিক কারণে বাংলাদেশের উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় পাওয়া ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে নিয়ন্ত্রন করছে ক্যাম্প ভিত্তিক ৩২ সন্ত্রাসী গ্রুপ। যার সবগুলোই সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল বলে পুলিশের খাতায় নাম এসেছে। সরাসরি মিয়ানমার থেকে অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপকে নিয়ন্ত্রন করার খবরও সুত্রে পাওয়া যায়। অবশ্য তন্মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘাতে থাকা শরণার্থীদের পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন ( আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরএসও), নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ এবং ইসলামি মাহাজ গ্রুপ অন্যতম। তাছাড়া পুরনো রোহিঙ্গা ( রেজিস্টার্ড ক্যাম্প) ও নতুন রোহিঙ্গাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, সুযোগ সুবিধা ও অন্যান্য কারণে প্রত্যক্ষ বিরোধ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অপরাধীদের অপরাধ দমনে কাজ করা হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও ক্যাম্পে থেমে নেই ইয়াবা পাচার, খুন, অপহরণ, নির্যাতন আর অস্ত্র মজুদের ঘটনা। এসব অপরাধে জড়িয়ে গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই শুধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে প্রায় ১২৫টি। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে আড়াই হাজারের উপরে। সুত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নীরবে চলছে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র, গোলা-বারুদ মজুদের মতো রাষ্ট্র বিধ্বংসী কার্যক্রম। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা না গেলে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বড় সংঘর্ষ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। সুত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এপিবিএন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকলেও সন্ধ্যা হলে কার্যত ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে। রাতে ক্যাম্প চলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ইচ্ছার ওপর। অধিকন্তু সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পে অপরাধ কর্ম সম্পাদন করে নির্বিঘ্নে মায়ানমার চলে যাবার সুযোগ থাকায় অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে মায়ানমার রাষ্ট্রের সুক্ষ্ম ইন্ধন রয়েছে বলে সাধারণ রোহিঙ্গা ও সচেতন মহলের ধারণা।
উখিয়া টেকনাফের বিস্তীর্ণ পাহাড়ের গহীন অরণ্যকে রীতিমতো অভয়ারণ্য তৈরি করে তুলেছে মাদককারবারি, সন্ত্রাসী ও অপহরণকারী চক্র। এ চক্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্টির সাথে স্থানীয় মাদককারবারী, দুর্বৃত্ত, দুষ্কৃতকারী, তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা সমানতালে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে যাচ্ছে বলে সুত্রে প্রকাশ।
অপরাধীচক্র এমন অপহরণ কাজে জড়িত আছে বলে আমরাও শুনেছি। তাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভুক্তভোগী কেউ সহজে পুলিশকে তথ্য দিতে চায় না’।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, ‘যেহেতু এলাকাগুলো দুর্গম, তাই কৃষকদের আমরা বলেছিলাম, তারা যেন পাহাড়ি এলাকায় সংঘবদ্ধ থাকে। কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে না নিয়ে যে যার মতো কাজে যায়। আর সুযোগ বুঝে তাদের অপহরণ করে অপরাধীরা। এতে আমদেরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তারপরও আমাদের সীমাবদ্ধতার মাঝে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে কিভাবে অপরাধ নির্মূল করা যায় তা নিয়ে কাজ করছি আমরা। গত ৬-মে-২৩ তারিখে অপহরণ চক্রের সদস্য রোহিঙ্গা শরনার্থী আমানুল্লাহ (২০), মো শফি ( ২২) কে অপহৃত ফয়সালের মোবাইলসহ হাতে নাতে আটক করা হয়’।
তিনি আরো যোগ করেন-‘ইতিমধ্যেও ১১-জানুয়ারি-২৩ তারিখে, টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ-টেকনাফ সদর থানাধীন সদর ইউনিয়নের মহেশখালীয়া পাড়ার জনৈক শফিকের বসত বাড়ি থেকে ১৭ জন পুরুষ, ৪ জন মহিলা, ৫ জন শিশুসহ মোট ২৬জন অপহৃতকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। সাথে অপহরণকারী সদস্যের ৪ জন পুরুষ ও ১ জন নারিসহ মোট ৫ জনকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছি। আমাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই।মাদক, ইয়াবা, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান অব্যাহত রেখেছি। সাথে এলাকার আইন শৃংখলা ও শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি’।
অপরাধ সংঘটিত হবার জন্য আমার মতে ৪ টি কারন রয়েছে। প্রথমতঃ রিপাট্রিশন বা প্রত্যাবাসন। যে রোহিঙ্গা নেতা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলবে তাদেরকে সন্ত্রাসী গ্রুপ হত্যা করতে পারে, দ্বিতীয়তঃ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বর্তমানে ইয়াবার স্বর্গ রাজ্যে পরিনত হয়েছে। হয়ত ইয়াবার লেনদেনের টাকার কারনে হত্যাকান্ড হতে পারে, তৃতীয়তঃ রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে যে স্মার্ট ফোন আছে, এগুলোর সাহায্যে তারা বিভিন্ন উগ্রপন্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে বলে সেসব উগ্র সন্ত্রাসীগোষ্টী এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে বলে আমার মনে হয় এবং চতুর্থতঃ রোহিঙ্গা জনগোষ্টী অবাধে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে কয়েকটি বাজার আছে। রোহিঙ্গাদের বাজারের নিয়ন্ত্রন বজায় রাখা ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য এসব অপরাধ কর্মকান্ড হয়ে থাকতে পারে বলে আমি মনে করি। নানাবিধ অপরাধকর্মের মধ্যে উপরে উল্লেখিত ৪টা কারণ যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস’।
ক্যাম্পগুলোতে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বারবারই ‘আরসাকে’ দায়ী করছেন সাধারণ রোহিঙ্গা ও রোহিঙ্গা নেতারা। রোহিঙ্গা নেতাদের অভিযোগ, ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণে পুরনো কৌশল বদলে নতুনভাবে এগোচ্ছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। টার্গেট করার ক্ষেত্রে আগের ছক বদল করেছে তারা। নতুন করে ‘সিঙ্গেল অ্যাটাক’ বা একক হামলার কৌশল নিয়েছে সশস্ত্র সংগঠনটি। ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গা নেতা আরসাকে সহযোগিতা করছে না, কিংবা তাদের হয়ে কাজ করছে না, টার্গেট করে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এমনকি তারা আগে রোহিঙ্গা নেতাদের কাছে ক্যাম্পে চাদাঁবাজি, মাদক ও চোরাচালানে সহযোগিতা চেয়ে প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। এরপরও যদি সহযোগিতা না করে তখন হত্যা করা হয়।
ইতিমধ্যে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ না করার নির্দেশ দেয় আরসা। নির্দেশ না মানায় হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ অবস্থায় নিরাপত্তা চেয়েছেন তারা।
তবে, অন্যদিকে বরাবরই পুলিশ বলছে, “ক্যাম্পে আরসা’র অস্তিত্ব নেই। চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক, চোরাচালান এবং মানবপাচারকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কয়েকটি গ্রুপ। বিভিন্নভাবে হুমকিদাতারা আরসার সদস্য নয়। তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। নিজেদের ভেঙে পড়া নেটওয়ার্ক জোড়াতালি দিতে নতুন কৌশলে আবারও সক্রিয় হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ভয়ভীতি তৈরি করে ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে”।
পরিশেষে বলা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক অপরাধ কর্মকান্ডের কারণ অনুসন্ধান পুর্বক, অপরাধ দমনে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে, এই রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে সামাল দেওয়া খুবই কঠিন ও কষ্টকর হয়ে পড়বে। আমাদের পুলিশ, এপিবিএন, র্যাব, বিজিবি ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কর্মরত বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীগুলোকে যথাযথ ভুমিকা পালন করতে হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে যথা সময়ে লাগাম টেনে ধরতে না পারলে দূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ভাইস প্রেসিডেন্ট উপজেলা প্রেসক্লাব উখিয়া ও প্রেসিডেন্ট- বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) উখিয়া উপজেলা শাখা।