।। এম আর আয়াজ রবি’।।
চাহিদা ও যোগানের নেতিবাচকতা, অভাব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে আজকে জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পরিপূর্ণ এবং অর্থনীতির চাকা স্লথ হয়ে আসছে। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অযাচিত দৈত্য।দু’মুঠো খেয়ে পরে জীবনধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য-যেন এক পাগলা ঘোড়ার লাহান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শিকার প্রধানত দেশের বিপুলসংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ-তথা কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, পেশাজীবী, কারিগর, নির্দিষ্টআয়ের মেহনতি মানুষগুলো।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য যে হারে বাড়ে সাধারণ মানুষের আয় বা মজুরি সেই হারে বাড়ে না। কৃষক সারাবছরে কষ্টার্জিত ফসলের যুক্তিসঙ্গত দাম পায় না, কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্যের সাথেসঙ্গতি রেখে বাড়ে না। নিশ্চিত অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত সাধারণ মানুষের জীবনের চলার গতি। আয়ের সাথে ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতার কারণে-ঠিক যেন অর্থনীতির ‘দারিদ্রের দুষ্টচক্রে’ আবর্তন করছে সাধারণমানুষের ভাগ্য।
প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন বেড়েই চলছে। সীমিত আয়েরমানুষগুলো প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্কঅত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভরকরে তাদের আয়, রুচি, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। নিত্যপ্রয়োজনীয়পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়,তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় চরম অশান্তি।দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ নিম্ন আয় ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া।
বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন চালাতে গিয়ে সীমিত আয়ের সৎ, অসচ্ছল মানুষের জীবনে নেমে আসে নিদারুনকষ্ট। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন সীমিত, তেমনি জিনিসপত্রের বাজারদর দ্বারাও তা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। বিত্তবানদের জন্য দ্রব্যমূল্য প্রত্যক্ষভাবে কখনোই তেমন প্রভাব বিস্তার করেনা। কারণ তাদের আয় প্রায় অসীম। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ট সাধারণ মানুষ যে আয় করে তা দিয়ে তাকে হিসাব করে চলতে হয়। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, মানুষের আয় যতটা বাড়ে সেই তুলনায় যদি জিনিসপত্রের দাম বেশিবৃদ্ধি পায়, তাহলেই তারক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্রয়ক্ষমতাই হলো তার ‘প্রকৃত আয়’। ‘প্রকৃত আয়’ বৃদ্ধি না পেয়ে যদি একই জায়গায় স্থির থাকে বাকমে যায় তাহলেই শুরু হয় জীবনের আশা ভঙ্গের নিদারুণ যন্ত্রণা। আর ‘প্রকৃত আয়’ কমে গেলে যে যন্ত্রণা- তার মাত্রার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। দ্রব্য মুল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা ‘প্রকৃত আয়’ কমতে থাকে। শুরু হয় দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের অযাচিত যাতনা। এরফলে, অর্থনীতির ভাষায় সাধারণ মানুষ ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’ এ আষ্টেপৃষ্টে ভর করে চলে।
বর্তমান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল,শাক-সবজি,দুধ, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদিসহ প্রতিটি দ্রব্যের মূল্যলাফিয়ে লাফিয়ে আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।ডিজেল, পেট্রোল, অকটেনসহ জ্বালানী তেলের লাগামহীন বৃদ্ধি, ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং, খাদ্য ঘাটতি, আমদানী নির্ভরতা, মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের মান বৃদ্ধি, ডলার সংকট,নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা, রিজার্ভের পরিমাননিম্নগামী হওয়া, অর্থনৈতিক প্রতিষ্টানগুলোর নাজুক হয়ে অর্থনৈতিক চাকা ঘূর্ণায়মাননা থাকা,যোগ্যতানুযায়ী কাজের অভাব-বেকার ও ছদ্মবেকারের আধিক্য প্রভৃতি কারণে আজমানুষের জীবনযাত্রা ওষ্টাগত।অন্যদিকে মানুষের আয় রোজগার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য , দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির অনুপাতে নাবাড়ায়,মানুষের আয়ের সিংহ ভাগ শুধুমাত্র খাওয়া দাওয়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনতে ব্যয় হয়। অন্ন বা খাদ্য ছাড়াও মানুষের নুন্যতম অন্যান্য মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে যেমন-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তসহ সাধারণখেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নিত্যদৈনন্দিন জীবন যাত্রায় দীর্ঘ নাভিশ্বাস উঠেছে। একদিকে গত দীর্ঘ প্রায় ৪ বছরবৈশ্বিক কোভিড-১৯ এর প্রভাব, অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ যেন মরার উপর খড়ার ঘা হয়ে আছে।
প্রত্যেকটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকারের কাছ থেকে মানুষ যে দু’টি বিষয় বেশিমাত্রায় প্রত্যাশা করেন- তার একটি হলো আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ বা উন্নতি, অন্যটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রন বা ঊর্ধ্বগতি রোধ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা জনগণের কাছে সরকারের মুষ্টিমেয় ভালকাজের বা সুকীর্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষংগ। এ ব্যাপারে সরকার তাদের সাধ্যের মধ্যে সব কিছু করবে্ন, জনগণ এটাই প্রত্যাশাকরেন। কিন্তু দেশ পরিচালনায় সরকারের অদুরদর্শীতা, অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অবহেলার কারণেদেশে নজিরবিহীন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর লাগামহীন উর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। যথাযথ বাজারমনিটরিং এর অভাব,বাজারের নিয়ন্ত্রনহীনতা ও শাসকদলীয় সিন্ডিকেটের কারণে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিরোধ করা যাচ্ছে না বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতহচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেসামগ্রীর মুল্য বৃদ্ধির পাশাপাশিবেড়েই চলছে বাসাভাড়া, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে অনবরত। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় সমানুপাতিক হারে বাড়ছেনা। ফলে জীবনযাত্রার মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়া মানেই দেশের বেশিরভাগ মানুষের ওপর চাপ পড়া। তাই সরকারকে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই শুধু নয়, পরিকল্পিতভাবে কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে। তখন উৎপাদন বাড়বে, বাড়বে ক্রয়ক্ষমতা। আয় বাড়লে মূল্যস্ফীতির আঘাতও হয় সহনীয়। কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুদদার প্রভৃতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ করা কঠিনতর হচ্ছে, দরিদ্রও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। জনজীবন আজ বিপর্যস্ত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বুভুক্ষু মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য করছে। মানুষের একটু ভালোভাবে বাঁচার দাবি আজ সর্বত্র। কিন্তুবাস্তব পরিস্থিতি তাদের প্রতিকূলে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করেঅশ্বগতিতে বেড়ে চলছে ব্যয়ের খাত। এরূপ হারে পানির বিল, গ্যাসবিল, জ্বালানি তেলের মূল্য ও দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত খরচজনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিইমূল্যের এরূপ বৃদ্ধিতে অসহায় ও নিরুপায় হয়ে পড়ে।পণ্যমূল্য নির্ধারণে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও তাপ্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ আইনের আওতায় দ্রব্যমূলের মূল্য নির্ধারণ, চোরাকারবারি প্রতিরোধ, ফড়িয়া ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণকরে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যেতে পারে। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় অথবা পরিকল্পনামন্ত্রণালয় এ পদক্ষেপ নিতে পারে। টিসিবিকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।নিয়মবহির্ভূতভাবে কেউ কেনাবেচা করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।ব্যবসায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে এ অবস্থার উন্নতি করা যেতে পারে।অবশেষে বলব ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং জনগণের সার্বিকসহযোগিতায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলে দেশের মানুষস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। এতে বাংলাদেশ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে ভবিষ্যতে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধহয়ে উঠবে এ বিশ্বাস আমাদের সবার।
লেখক: কলামিস্ট, পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী