১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে নিজ বাবার খুনি মোস্তফিজের স্বীকারোক্তি
আইকন নিউজ ডেস্কঃ
‘বাবা আমাকে গালে থাপ্পর মারে।’ আমার মাথা তখন গরম হয়ে যায়
সহ্য করতে না পেরে দু’হাতে বাবার গলা চেপে ধরি । এক চাপেই বাবা মারা যান। ছোট ভাইসহ লাশ টুকরো করার আগে বাবার মুখটি যাতে চোখে না পড়ে সেজন্য গামছায় ঢেকে দিই। এভাবে আদালতে জন্মদাতা পিতাকে খুনের বর্ণনা দিলেন পুত্র মো. মোস্তাফিজুর রহমান (৩২)।
গতকাল বুধবার মহানগর হাকিম মো. সাদ্দাম হোসেনের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় এ জবানবন্দি দেন মোস্তাফিজ। জবানবন্দির বরাত দিয়ে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, মোস্তাফিজের ছোট ভাই মিলে তার পিতা মোহাম্মদ হাসানের লাশ টুকরো টুকরো করে তা গুম করার লোমহর্ষক বর্ণনাও দিয়েছেন। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এর আগে গত রোববার মোস্তাফিজ ও তার মা ছেনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে আনা হয়। গতকাল তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান পিবিআই মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক মো. ইলিয়াছ খান। গত শুক্রবার রাতে বাঁশখালীর কাথারিয়া থেকে মোস্তাফিজ ও তার মাকে গ্রেফতার করে পিবিআই। গ্রেফতারের পর তার দেখানো মতে, নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পাশের একটি নালা থেকে মো. হাসানের লাশের একাংশ উদ্ধার করা হয়।
তার আগে ২১ সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় একটি ট্রলিব্যাগ থেকে হাত-পাসহ লাশের আটটি খণ্ড উদ্ধার করে পুলিশ। গতকাল পর্যন্ত মো. হাসানের খণ্ডিত মস্তক উদ্ধার করা যায়নি। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে মোস্তাফিজ বলেন, আমার যখন বয়স সাত বছর তখন বাবা চাকুরির কথা বলে শহরে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকে তার আর কোনো খবর পাইনি। বছরের পর বছর ফিরে না। আসায় এলাকার মানুষ মনে করত আমার বাবা মারা গেছেন। আমরা তিন ভাই-বোন মা এবং দাদির কাছে বড় হই। ২৮ বছর পর বাবা ফিরে আসেন । আমার বাবা নিখোঁজ থাকায় জেঠা মাহবুব আলী ও জেঠি রাবেয়া বেগম আমাদের অত্যাচার করে ভিটে থেকে বের করে দিতে চাইতো। একপর্যায়ে আমার মা দাদি ও আমাদের লালন-পালন করতে ভিক্ষা করেন। দুই বছর আগে বাবা বাড়ি ফিরে আসলে সমাজের মুরব্বিদের ডেকে আনি।
তারা বাবার কাছে জানতে চান, তুমি কি সন্তানদের কাছে থাকবে নাকি আবার চলে যাবে। বাবা জবাব দেন, ছেলেরা বড় হয়েছে তারা যেভাবে বলে সেভাবে থাকব। কিন্তু তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করেন। একবার বলেন তার আরেকটি সংসার আছে। আবার বলেন তিনি জাহাজে চাকরি করেন সেখানে ফিরে যাবেন। এভাবে ৭-৮ মাস তিনি আমাদের সাথে বাড়িতে ছিলেন। তারপর জাহাজে যাবেন বলে ফের বাড়ি ছাড়েন। এ সময় আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও আমার জেঠা-জেঠীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করেন । কারণ তারা আমাদের ভিটে-বাড়ি কিনে নিতে চান। তিন মাস আগে বাবা আবার বাড়ি ফিরে আসেন। এসে আমাদের ঘরে না উঠে প্রতিবেশীদের ঘরে থাকেন। এর মধ্যে আমার মায়ের সাথে ঝগড়া শুরু করেন।
কয়েকদিন আগে আমার ছোট ভাইকে টেলিফোনে জানান, ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন। একপর্যায়ে বাবা আমার ছোট ভাইয়ের আকমল আলী রোডের বাসায় গিয়ে উঠেন। খবর পেয়ে আমার মাও সেখানে চিকিৎসার জন্য যান। ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় আমিও ছোট ভাইয়ের বাসায় যাই। বাবা রাত ৮টার মধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আমরা তার সাথে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। পরদিন সকাল ৮টায় বাবা ছোট ভাইয়ের সাথে চৌকিতে বসা ছিল। তখন আমি পারিবারিক বিষয়ে আলাপ শুরু করি। একপর্যায়ে বাবা বলেন, তোরা আমার সন্তান না। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে বাবা আমাকে থাপ্পর মারেন। এরপর বাবাকে গলা চিপে হত্যা করি। দুই ভাই মিলে লাশ মুড়ির প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে ঘরের কোণায় রেখে দিই। এরপর চিন্তা করি কিভাবে লাশটা সরাবো। বিকেল ৩টায় ছোট বোনের জামাই ফোরকানকে ডেকে এনে মাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। সন্ধ্যা ৬টায় ছোট ভাই বাবার লাশের বস্তাটা তার রুমে নিয়ে যায়। দুই ভাই মিলে লাশ সরানোর পরিকল্পনা করি। বাবার লাশের বস্তাটা খুব ভারী ছিল। তাই কিভাবে লাশ সামলাবো চিন্তায় পড়ে যাই। সিদ্ধান্ত নিই লাশ টুকরো টুকরো করে দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেব। ছোট ভাইকে পলিথিন আর স্কচ টেপ আনতে পাঠাই। এরপর ঘরে থাকা দামা দিয়ে লাশ কাটা শুরু করি। বাবার চেহারা যাতে চোখে না পরে সেজন্য মাথার উপরে একটি গামছা দিয়ে দিই। তারপরে হাত দুটি এবং হাঁটুর উপর থেকে পা দুটি কাটি। তারপর হাত চার টুকরো ও পা চার টুকরো করি। এসব টুকরো পলিথিন ও স্কচ টেপ পেচিয়ে ছোট ভাইয়ের স্যুটকেসে ভরি। মাথাটা স্যুটকেসে ভরতে না পেরে একটি শপিং ব্যাগে ভরে রুমের কোণায় রাখি। ছোট ভাই বলে মাথ াটা সে ফেলবে। শরীরের মূল অংশ পলিথিন ও স্কচ টেপ পেঁচিয়ে প্লাস্টিকের চালের বস্তায় ঢুকাই । রাত ৩টার সময় ছোট ভাই একজন নেশাখোর ব্যক্তিকে ডেকে আনে। তিনি লাশের খণ্ডভর্তি বস্তাটি বাসার অদূরে খালে ফেলে দেন। পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর ফজরের আজানের পর ছোট ভাইয়ের বউ আনারকলিসহ প্রথমে রিকশায় সিমেন্ট ক্রসিং এবং সেখান থেকে অটোরিকশায় করে ১২ নম্বর ঘাটে যাই। সেখানে লাগেজটি রাস্তার পাশে ফেলে দিই। ছোট ভাই ও তার বউ ১৫ নম্বর ঘাটে চলে যায়। আমি বাড়ি চলে যাই। বাড়ি গিয়ে দেখি মা নানা বাড়িতে। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি বলি মেরে ফেলেছি। মা কপালে আঘাত করে কান্না শুরু করেন। শুক্রবার আমাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। মাকেও নানা বাড়ি থেকে তুলে নেন। রিমান্ডে যাওয়ার পর জানতে পারি বাবার লাশ জেঠা মাহবুব আলীসহ সৈয়দ মেম্বার নিয়ে যান। আমাদের ঘরের ভেতরে তাকে কবর দেওয়া হয়।